হতাশা এবং বিষন্নতার মধ্যে পার্থক্য কী?

হতাশা এবং বিষন্নতার মধ্যে পার্থক্য কী

বর্তমানে কোভিড প্যানডেমিকে বিভিন্ন কারণে মানুষের মধ্যে হতাশা-বিষন্নতা যাই বলিনা কেন তা দেখা দিচ্ছে এবং অধিকাংশই এটাকে খুব একটা আমলে না নিয়ে হেসে ওড়িয়ে দেন। এতে পরিণতি এমন কিছু হয়ে যাবার সম্ভাবনা থাকে যাকে পূণরায় আগের অবস্থায় আনা সম্ভবপর নয়।

হতাশাকে যদি ইংরেজি করি তাহলে ধরে নেই এটা দিয়ে Frustration বুঝানো হচ্ছে। আর বিষন্নতা দিয়ে বুঝানো হচ্ছে Depression। যদিও Depression এর মানেও হতাশা করা যায়। তবে এখানে আরেকটু স্পষ্ট করে বললে বলতে হবে Depression এবং Clinical depression এর মধ্যে অনেক পার্থক্য আছে।
আমরা এখানে তাই হতাশা মানে- Frustration/ Depression এবং বিষন্নতা মানে Clinical Depression বুঝে নিবো এবং সে অনুসারেই পরবর্তী আলোচনা করবো।

হতাশা/Frustration কি?
হতাশা মানে নিজের প্রত্যাশা অনুসারে ফল না পাওয়ার আবেগ/প্রতিক্রিয়া। অতীতের কোন সিদ্ধান্ত কিংবা ভবিষ্যতের কোন সম্ভাবনা নিয়ে কষ্ট পাওয়া, রাগান্বিত হওয়া, দুঃখিত হওয়া। পরীক্ষায় ফেল করলে হতাশা আসতে পারে, খেলায় জিততে না পারলে আসতে পারে, পছন্দের মানুষকে না পেলে আসতে পারে, চাকরি না পাওয়া বা মনমতো না হলেও হতাশা আসতে পারে।

এটা কোন ক্লিনিক্যাল ডিজঅর্ডার নয়। এর জন্যে ডাক্তারের শরণাপন্ন হতে হয়না। উপযুক্ত পরিবেশ এবং উৎসাহ পেলে এটা ঠিক হয়ে যায়। পরীক্ষায় ফেলের দুঃখ একদিন থাকে। পরেরদিন কিন্তু সব আগের মতোই চলে।
এই হতাশা বা ফ্রাস্ট্রেশন আসে মূলত বুঝার ঘাটতি থেকে। খুব দ্রুতই আমরা চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়ি এবং ভালভাবে বিচার-বিশ্লেষণ না করেই সিদ্ধান্ত নিতে যাই বলে হতাশা আসে। তবে এধরণের হতাশা থেকে নিজেরাই বের হয়ে আসতে পারি। চিকিৎসকের পরামর্শের প্রয়োজন পড়েনা।

কিভাবে হতাশা/ ফ্রাস্ট্রেশন থেকে মুক্তি পাওয়া যেতে পারেঃ
আপনার যা আছে এই মুহুর্তে সেটাকে এপ্রিশিয়েট করুন। নিজের যা আছে তাই নিয়ে নিজেকে সান্ত্বনা দিন। খুঁজলে দেখবেন অনেকে এসব ছাড়াও অনেক সুখী হয়ে বাঁচতেছে। যাদের এতেও হচ্ছেনা- তারা অন্তত মাথার উপর ছাদ, নিরাপদ পানি, খাদ্য এবং ইন্টারনেট সুবিধার কথা ভাবুন।

এই মুহুর্তে আপনার এই হতাশা থেকে মুক্তি পেতে কি করার সামর্থ্য আছে?
আপনার ভুলগুলো খুঁজুন। আপনার সামর্থ্যের মধ্যে যা আছে তাকে আর কিভাবে কাজে লাগানো যায় ভাবুন। যা হয়নি হয়নি। এখন কি করলে অবস্থার কিছুটা হলেও উন্নতি হবে সেইদিকে মনোযোগ দিন। জীবনে অনেক কিছু হয়ত একবার চেষ্টা করে পেয়ে গেছেন, কিন্তু অনেক কিছুই আছে যার জন্যে বারবার চেষ্টা করতে হয়। তথ্য জোগাড় করুন, প্ল্যান করুন, কাজে নেমে যান।

এবার তাহলে জানা যাক, বিষন্নতা/Clinical Depression কি?
বিষন্নতা হতাশার চূড়ান্ত একটা রূপ। এটা ক্লিনিক্যাল এবং এর জন্যে আপনাকে অবশ্যই কারো সাহায্য অর্থাৎ ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে।
হতাশা এবং বিষণ্ণতার মধ্যে পার্থক্য করতে হলে আপনাকে যেটা জানতে হবে তা হলো- যদি কারো হতাশা/দুঃখবোধ অন্তত দুই সপ্তাহ বা তার বেশি থাকে তবে তা ক্লিনিক্যাল ডিপ্রেশনে আওতায় চলে যায়। সাধারণত ব্রেইনে কিছু নিউরোট্রান্সমিটারের অভাবকে এর পেছনে দায়ী করা হয়। তাই একা একা এর সমাধান করা যায়না, আপনাতে চলে যাবে এমন ভেবে অবহেলা করা যায়না। এই বিষণ্ণতার অনেকগুলি উপসর্গ রয়েছে। ভালভাবে খেয়াল করুন।

  1. • দুই সপ্তাহ বা তার বেশি সময় ধরে দুঃখবোধ/ শূন্যতা অনুভব করা।
    • আশাহীনতা এবং সাহায্যহীনতা অনুভব করা।
    • সাধারণত যে কাজে আনন্দ/মজা পেত এমন কাজে মজা না পাওয়া
    • খাদ্যাভাসে/ রুচিতে পরিবর্তন চলে আসা
    • বমিভাব, মাথাব্যথা, দীর্ঘস্থায়ী ব্যথায় ভোগা
    • ঘুমের প্যাটার্নে চেঞ্জ আসা (খুব বেশি ঘুমানো/ একেবারেই ঘুম না হওয়া)
    • নিজেকে পরিবার এবং বন্ধুদের কাছ থেকে গুটিয়ে নেয়া
    • কোনকিছুতে মনোযোগ দিতে ব্যর্থ হওয়া
    • সবসময় প্রচন্ড প্রেশারে থাকা কিংবা চিন্তাগ্রস্ত থাকা
    • সবসময় ক্লান্তিভাব থাকা
    •আত্মহত্যার চিন্তা করা

বিষন্নতা আপনার প্রাত্যহিক জীবনকে নানাভাবে প্রভাবিত করতে পারে। শুধুমাত্র খাওয়া-ঘুমে প্রভাব পড়বে এমন না। পড়াশুনা-চাকরি-ক্যারিয়ার-সম্পর্ক সহ সবকিছুতে নেগেটিভ একটা প্রভাব আসবে। প্রোডাক্টিভিটি কমে যাবে। এজন্যে এক্ষেত্রে সাহায্য চাওয়া জরুরি। শুধু নিজের জন্যে নয়; রিলেশন-ক্যারিয়ার এবং পরিবারের ভালো জন্যে আপনাকে এর মধ্যে থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। তবে এই বেরিয়ে আসার জন্যে আপনার ব্যক্তিগত চেষ্টা যথেষ্ট হবেনা।
বিষন্নতা থেকে মুক্তি পেতে আপনি কি করতে পারেন?
পরিবারের সবচেয়ে কাছের মানুষটিকে, সবচেয়ে ভাল বন্ধুটিকে আপনার কথা শেয়ার করতে হবে। ভাল হয়, একজন থেরাপিস্ট কিংবা মানসিক ডাক্তারের কাছে যাওয়া। প্রচলিত মিথকে কানে নিয়ে নিজেকে গুটিয়ে রেখে আপনাতেই চলে যাবে এমন ভেবে ভুল করা যাবেনা। কাউন্সেলিং এ যেতে হবে। মুখোমুখি কথা বলতে ইচ্ছে না করলে অনলাইনে কিংবা ফোনে আপনাকে কাউন্সেলিং নিতে হবে।
এছাড়া যা করবেন।

• প্রতিদিন ব্যায়াম করা এবং স্বাস্থ্যসম্মত খাবার খাওয়া
• পর্যাপ্ত ঘুম এবং বিশ্রাম নিশ্চিত করা
• একটা লক্ষ্য খুঁজে নেয়া। নিজের উপর মনোযোগ সরিয়ে অন্যকিছুতে মনোযোগ দেয়া।
• ছোট ছোট কিছু কাজের লিস্ট তৈরি করা। সেগুলো পূরণে কাজ চালানো এবং সফল হলে আত্মতৃপ্তি নেয়া।
• ঘুমানোর আগে জার্নালে নিজের কথাগুলো লিখে ফেলা। নিজের চিন্তাগুলোকে জট মুক্ত করা।
• ক্রিয়েটিভ কিছু করা। ভলান্টিয়ারিং করা। এতে মনোযোগ অন্যদিকে ব্যস্ত থাকে।
• নিজেকে কোনভাবেই আলাদা করে ফেলা যাবেনা। পরিবার এবং বন্ধুদের মাঝে থাকা নিশ্চিত করা।

অনেকে ভেবে থাকেন ক্লিনিক্যাল ডিপ্রেশন শুধুমাত্র মানসিক সমস্যাই করে। এমন কিন্তু নয়। এর কারণে শারীরিক সমস্যাও দেখা দিতে পারে। ডিপ্রেশন শুধু মেয়েদের বা মেয়েদের বেশি হয় এমন ধারণাও ভুল।
ক্লিনিক্যাল ডিপ্রেশনের অনেক কারণের মধ্যে যেটা জানা জরুরি সেটা হল- আমাদের মস্তিষ্কে কেমিক্যাল নিউরোট্রান্সমিটার কমে যাবার কারণে ক্লিনিক্যাল ডিপ্রেশন দেখা দেয়। এটা ডায়াবেটিস হলে যেমন ইনসুলিন কমে যায়, তখন আপনার অগ্ন্যাশয়/প্যানক্রিয়াস যেমন আপনি চাইলেও ইনসুলিন ক্ষরণ করতে পারেনা এখানেও তেমনি। আপনি চাইলেই সে নিউরোট্রান্সমিটারগুলো বেশি তৈরি করাতে পারবেন না। একারণে একা একা এই সমস্যার সমাধান করার চেষ্টাতে কোন লাভ হয়না। এটা একটা ক্লিনিক্যাল রোগ। তাই উপযুক্ত লোকের শরণাপন্ন হতে হবে। হেলাফেলা করা যাবেনা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back To Top
Share via
Copy link
Powered by Social Snap